Category: ফিকহ (Page 2 of 3)
বিষয়ঃ আযানের দোয়ার শেষে ‘ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’ বলা প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের আহলে হাদীস ভাইয়েরা তাদের শায়খদেরকে অন্ধভাবে তাকলিদ করার একটা দৃষ্টিভঙ্গি হল আহলে হাদীস আলেমদের তাহকীক আরবের আলেমদের তাহকীকের বরারব। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই বিপরীত। যে সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেম ও আরবের আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হল আযানের দোয়ার শেষে ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’ বলা প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেমদের তাহকীকঃ
শায়খ মুরাদ বিন আমযাদ সাহেব বলেন –
“আযানের দু’আ প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে রেডিও, টিভি ইত্যাদি প্রচার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ফকহী গ্রন্থে কিছু অতিরিক্ত শব্দ বলা হয়, যেমন ‘ওয়াদারাজাতির রাফিয়া’ এবং ‘ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’”(বেহেশতী জেওর, ২/১২২, মাসআলা-৯)(প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সালাত আদায়ের পদ্ধতি পৃ-১৪)
তালফীক ও তার হুকুমঃ
তালফীকের পরিচয়ঃ তালফীকের শাব্দিক অর্থ হল, একত্র করা বা মিলান। তালফীকের পারিভাষিক সংজ্ঞায় উলামায়ে কেরামের মাঝে শাব্দিক কিছু তারতম্য থাকলেও মৌলিক দিক থেকে তালফীককে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে-
الجمع بين المذاهب الفقهية المختلفة في أجزاء الحكم الواحد
অর্থাৎ একই হুকুমের বিভিন্ন অংশের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের মতামতকে একত্র করাকে তালফীক বলে।
তালফীকের সার কথা হল, কোন ব্যক্তি কখনও হানাফী মাযহাবের কিছু মাসআলা, কখনও শাফেয়ী, কখনও মালেকী বা অন্য কোন ইমামের মাযহাবের কিছু মাসআলা অনুসরণ করে থাকে। এভাবে সে চার মাযহাব বা অন্য কোন ইমামের কোন মতামতকে তার ইচ্ছানুযায়ী গ্রহণ করে থাকে, এধরণের ব্যক্তির এ আমলকে তালফীক বলে।
এ ব্যক্তির এক মাযহাব থেকে আরেক মাযহাবের দিকে স্থানান্তরের বিষয়টি তিনটি বিষয় থেকে খালি নয়-
১. কোন বিশেষ কারণে স্থায়ীভাবে সে অন্য মাযহাব গ্রহণ করেছে। বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও বৈধ। এধরণের কাজে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
২. এ ব্যক্তি সুযোগ সন্ধানী হয়ে বিভিন্ন মাযহাবের মাঝে যেটি পছন্দ হয়, সেটি গ্রহণ করে। এধরণের কাজ নিন্দনীয় ও অবৈধ।
৩. কোন একটি নির্দিষ্ট মাসআলার ক্ষেত্রে ইজতেহাদের যোগ্য ব্যক্তি দলিলের আলোকে উদ্দিষ্ট মাসআলা আহরণের জন্য প্রয়াসী হয়ে বিভিন্ন মাযহাবের দলিল বিশ্লেষণ ও তা অবলম্বন করবে।
এ ব্যক্তি যদি ইজতেহাদের যোগ্য হয় এবং প্রান্তিকতা, স্থূলতা, দৃষ্টির সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয় এবং তার এ গবেষণায় ন্যায়-পরায়ণ হয়, তবে তা শুধু বৈধই নয়, বরং তা ফিকহ শাস্ত্রের একটি প্রশংসনীয় কাজ।
কিন্তু এ ব্যক্তি যদি ইজতেহাদের যোগ্য না হয়, গবেষণায় সত্যানুসন্ধানী-ন্যায়পরায়ণ না হয় এবং প্রান্তিকতার দোষে দুষ্ট হয়, তবে এ ব্যক্তির এ কাজ শুধু নিন্দনীয় নয় বরংএটি তার ঈমান ও আমলের জন্য একটি ধ্বংসাত্মক বিষয়।
ইসলামে ফেকাহ শাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ আমল ফেকাহশাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের জন্ম থেকে কবরে কাফন সহ যাবতীয় আমল ফিকহ শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে। ঈবাদত ছাড়াও লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি এক কথায় একজন মুসলমানের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফিকহশাস্ত্রের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ফিকহ শাস্ত্রের বিষয়গুলো এমন যে, এ ব্যাপারে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন ব্যতীত কোন মতামত দেয়া নিতান্তই বোকামী। আর যারা এ বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন, তাদেরক্ষেত্রেও দেখা যায়, এ বিষয়ে কোন মতামত দিতে গেলে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। রাসূল (সঃ) বলেছেন,
من قال علي ما لم أقل فليتبوأ بيتاً في جهنم ، ومن أُفتى بغير علم كان إثمه على من أفتاه ، ومن أشار على أخيه بأمر يعلم الرشد في غيره فقد خانه
“যে ব্যক্তি এমন কথা বলল, যা আমি বলিনি, তবে সে জাহান্নামে নিজের জন্য একটি ঘর তৈরি করল। আর যাকে ইলম ব্যতীত ফতোয়া প্রদান করা হল, এর গোনাহ ফতোয়া প্রদান কারীর উপর বর্তাবে। আর যে ব্যক্তি তার ভাইকে এমন বিষয়ে পরামর্শ দিল যার বিপরীত বিষয়ের মাঝে সে কল্যাণ দেখছে, তবে সে তার সাথে প্রতারণা করল”
[মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকী শরীফ]
খতীব বাগদাদী (রহঃ) “ আল-ফকীহ ও য়াল মুতাফাক্কিহ” নামক কিতাবে লেখেছেন,
قيل لبعض الحكماء : إن فلانا جمع كتبا كثيرة! فقال : هل فهمه علي قدر كتبه؟ قيل : لا، قال فما صنع شئا، ما تصنع البهيمة بالعلم.
কোন এক বিজ্ঞজনকে বলা হল, অমুক ব্যক্তি অনেক কিতাব সংগ্রহ করেছে। তিনি তাকে বললেন, তার বুঝ কি তার সংগৃহীত কিতাবের সমান? লোকটি উত্তর দিল, না। তখন তিনি বললেন, প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই করেনি। চুতষ্পদ জন্তু ইলেম দিয়ে কী করবে!
অর্থাৎ বুঝ অর্জন না করে, কিতাব সংগ্রহ করা আর একটি জন্তুর নিকট অনেক কিতাব থাকা সমান।
সুতরাং কিতাব সংগ্রহের নাম ইলম নয়। কারও নিকট অধিক হাদীস থাকার কারণে সে যদি বড় হালেম হয়ে যেত, তবে যার নিকট এক ডিস্কের মধ্যে সমস্ত হাদীসের কিতাব রয়েছে, সেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেম হয়ে যেত। চল্লিশ টাকার একটা ডিস্ক সংগ্রহ করা, আর ইলমের পিছে চল্লিশ বৎসর সাধনা করা এক জিনিস নয়। সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির দোহাই দিয়ে একথা বলা যথেষ্ঠ নয় যে, আমার নিকট এক মিলিয়ন হাদীসের একটি ডিস্ক আছে, সুতরাং কাউকে অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা নেই। বিষয়টি যদি এমনই হত, তবে পৃথিবীর যে কেউ ডিস্ক সংগ্রহ করবে, সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ আলেম হয়ে যাবে।