শরীয়তের যেসব মাসআলায় গবেষণার সুযোগ রয়েছে এগুলোকে ইজতিহাদী মাসআলা বলে। ইজতিহাদী মাসআলাগুলো নিয়েই মূলত: মতবিরোধ হয়ে থাকে। মতবিরোধপূণর্ ইজতিহাদী মাসআলার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সত্য কোনটি, তা বের করার তিন’টি পদ্ধতি রয়েছে।
১. আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সতে্যর ব্যাপারে ফয়সালা আসা। যেমন বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সত্যটি আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন।
২.সরাসরি রাসূল স.কে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া।
৩. মুসলিম উম্মাহের মাঝে ইজমা সংগঠিত হওয়া। কারণ রাসূল স. বলেছেন, আমার উম্মত ভ্রষ্টতার উপর একমত হবে না।
Category: মাযহাব (Page 1 of 2)
এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। আমল থেকে গা বাঁচানোর জন্য এবং ভুল থেকে ফিরে আসার সংকল্প না থাকলে অতি নিরীহভাবে এই অজুহাত দাঁড় করানো হয় যে, আমাদের কী করার আছে? আলিমদের মাঝে এত মতভেদ, আমরা কোন দিকে যাব? কার কথা ধরব, কার কথা ছাড়ব?
আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।
১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা, যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত, যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস, আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, জুমার নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ, মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!
তিনজন শায়খ হলেন শায়খ আব্দুল আযিয আব্দুল্লাহ বিন বায রাহঃ, শায়খ মুহাম্মদ ইবনে সালেহ আল উসাইমিন রাহঃ, শায়খ সালেহ আল ফাউযান হাফিযাহুল্লাহ।
শায়খ আব্দুল আযিয আব্দুল্লাহ বিন বায রাহঃ
ইবনে বাজের সাক্ষরিত একটি রেজুলেশনের অংশ –
আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের মাযহাবী ইখতিলাফ আমাদের দ্বিনের জন্য দোষের কিছু নয় এবং তা স্ববিরধিতাও নয়। এ ধরনের মতভেদ না হওয়া অসম্ভব। এমন কোন জাতি পাওয়া যাবে না যাদের আইন-ব্যাবস্থায় এ ধরনের ইজতিহাদী মতপার্থক্য নেই।
‘অতএব বাস্তব সত্য এই যে, এ ধরনের মতভেদ না হওয়াই অসম্ভব। কেননা একদিকে যেমন নুসূসে শরঈ অনেক ক্ষেত্রে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে অন্যদিকে শরঈ নস সম্ভাব্য সকল সমস্যাকে সুস্পষ্টভাবে বেষ্টন করতে পারে না। কারন নুসূস হল সীমাবদ্ধ আর নিত্যনতুন সমস্যার তো কোন সীমা নেই।
‘সুতরাং যে মতপার্থক্য কল্যান ও রহমতের ধারক তা বিদ্যমান থাকলে দোষ কেন হবে? বরং এ তো মুমিন বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার রহমত ও অনুগ্রহ। বরং মুসলিম উম্মাহর গর্ব ও গৌরবের বিষয়।
‘কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, কিছু মুসলমান তরুন বিশেষত করে যারা বাইরে লেখাপড়া করতে যায় তাদের ইসলামী জ্ঞানের দুর্বলতার সুযোগে কিছু গোমরাহকারী লোক তাদের সামনে ফিকহী মাসআলার এ জাতীয় মতপার্থক্যকে আকীদার মতভেদের মতো করে তুলে ধরে। অথচ এ দু’য়ের মাঝে আকাশ-পাতালের ব্যাবধান!‘দ্বিতীয়ত যে শ্রেনীর লোকেরা মানুষকে মাযহাব বর্জন করার আহবান করে এবং ফিকহের মাযহাব ও তার ইমাম গনের সমালোচনা করে এবং মানুষকে নতুন ইজতিহাদের মধ্যে নিয়ে আসতে চায় তাদের কর্তব্য, এই নিকৃষ্ট পন্থা পরিহার করা। যা দ্বারা তারা মানুষকে গোমরাহ করছে এবং তাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। অথচ এখন প্রয়োজন ইসলামের দুশমনদের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করা।
– মাজাল্লাতুল মাজলায়িল ফিকহী, রাবিতাতুল আলামিন ইসলামী, মক্কা মুকাররমা বর্ষঃ ১, সংখ্যাঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ৫৯,২১৯
বিষয়ঃ আযানের দোয়ার শেষে ‘ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’ বলা প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের আহলে হাদীস ভাইয়েরা তাদের শায়খদেরকে অন্ধভাবে তাকলিদ করার একটা দৃষ্টিভঙ্গি হল আহলে হাদীস আলেমদের তাহকীক আরবের আলেমদের তাহকীকের বরারব। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই বিপরীত। যে সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেম ও আরবের আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হল আযানের দোয়ার শেষে ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’ বলা প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেমদের তাহকীকঃ
শায়খ মুরাদ বিন আমযাদ সাহেব বলেন –
“আযানের দু’আ প্রচলিত ভুলঃ আমাদের দেশে রেডিও, টিভি ইত্যাদি প্রচার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ফকহী গ্রন্থে কিছু অতিরিক্ত শব্দ বলা হয়, যেমন ‘ওয়াদারাজাতির রাফিয়া’ এবং ‘ইন্নাকালা তুখলিফুল মি’আদ’”(বেহেশতী জেওর, ২/১২২, মাসআলা-৯)(প্রচলিত ভুল বনাম রসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সালাত আদায়ের পদ্ধতি পৃ-১৪)
- ইমামগণের মতভেদে হাদীসের ভূমিকা।
- মাজহাব প্রসঙ্গে ডা.জাকির নায়েক, একটি গবেষণামূলক পযর্ালোচনা
- নামায সংক্রান্ত মাসআলায় আরব আলেমদের মতবিরোধ
- তাবলীগ বিরোধী অপপ্রচারের জবাব
- ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বা সূফীবাদ
- ইমাম বোখারী রহ. এর ব্যাপারে নাসীরুদ্দীন আলবানীর তাকফিরী মনোভাব
একত্রে সকল বইয়ের লিংক
তালফীক ও তার হুকুমঃ
তালফীকের পরিচয়ঃ তালফীকের শাব্দিক অর্থ হল, একত্র করা বা মিলান। তালফীকের পারিভাষিক সংজ্ঞায় উলামায়ে কেরামের মাঝে শাব্দিক কিছু তারতম্য থাকলেও মৌলিক দিক থেকে তালফীককে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে-
الجمع بين المذاهب الفقهية المختلفة في أجزاء الحكم الواحد
অর্থাৎ একই হুকুমের বিভিন্ন অংশের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের মতামতকে একত্র করাকে তালফীক বলে।
তালফীকের সার কথা হল, কোন ব্যক্তি কখনও হানাফী মাযহাবের কিছু মাসআলা, কখনও শাফেয়ী, কখনও মালেকী বা অন্য কোন ইমামের মাযহাবের কিছু মাসআলা অনুসরণ করে থাকে। এভাবে সে চার মাযহাব বা অন্য কোন ইমামের কোন মতামতকে তার ইচ্ছানুযায়ী গ্রহণ করে থাকে, এধরণের ব্যক্তির এ আমলকে তালফীক বলে।
এ ব্যক্তির এক মাযহাব থেকে আরেক মাযহাবের দিকে স্থানান্তরের বিষয়টি তিনটি বিষয় থেকে খালি নয়-
১. কোন বিশেষ কারণে স্থায়ীভাবে সে অন্য মাযহাব গ্রহণ করেছে। বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও বৈধ। এধরণের কাজে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
২. এ ব্যক্তি সুযোগ সন্ধানী হয়ে বিভিন্ন মাযহাবের মাঝে যেটি পছন্দ হয়, সেটি গ্রহণ করে। এধরণের কাজ নিন্দনীয় ও অবৈধ।
৩. কোন একটি নির্দিষ্ট মাসআলার ক্ষেত্রে ইজতেহাদের যোগ্য ব্যক্তি দলিলের আলোকে উদ্দিষ্ট মাসআলা আহরণের জন্য প্রয়াসী হয়ে বিভিন্ন মাযহাবের দলিল বিশ্লেষণ ও তা অবলম্বন করবে।
এ ব্যক্তি যদি ইজতেহাদের যোগ্য হয় এবং প্রান্তিকতা, স্থূলতা, দৃষ্টির সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয় এবং তার এ গবেষণায় ন্যায়-পরায়ণ হয়, তবে তা শুধু বৈধই নয়, বরং তা ফিকহ শাস্ত্রের একটি প্রশংসনীয় কাজ।
কিন্তু এ ব্যক্তি যদি ইজতেহাদের যোগ্য না হয়, গবেষণায় সত্যানুসন্ধানী-ন্যায়পরায়ণ না হয় এবং প্রান্তিকতার দোষে দুষ্ট হয়, তবে এ ব্যক্তির এ কাজ শুধু নিন্দনীয় নয় বরংএটি তার ঈমান ও আমলের জন্য একটি ধ্বংসাত্মক বিষয়।
ইসলামে ফেকাহ শাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ আমল ফেকাহশাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের জন্ম থেকে কবরে কাফন সহ যাবতীয় আমল ফিকহ শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে। ঈবাদত ছাড়াও লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি এক কথায় একজন মুসলমানের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফিকহশাস্ত্রের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ফিকহ শাস্ত্রের বিষয়গুলো এমন যে, এ ব্যাপারে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন ব্যতীত কোন মতামত দেয়া নিতান্তই বোকামী। আর যারা এ বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন, তাদেরক্ষেত্রেও দেখা যায়, এ বিষয়ে কোন মতামত দিতে গেলে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। রাসূল (সঃ) বলেছেন,
من قال علي ما لم أقل فليتبوأ بيتاً في جهنم ، ومن أُفتى بغير علم كان إثمه على من أفتاه ، ومن أشار على أخيه بأمر يعلم الرشد في غيره فقد خانه
“যে ব্যক্তি এমন কথা বলল, যা আমি বলিনি, তবে সে জাহান্নামে নিজের জন্য একটি ঘর তৈরি করল। আর যাকে ইলম ব্যতীত ফতোয়া প্রদান করা হল, এর গোনাহ ফতোয়া প্রদান কারীর উপর বর্তাবে। আর যে ব্যক্তি তার ভাইকে এমন বিষয়ে পরামর্শ দিল যার বিপরীত বিষয়ের মাঝে সে কল্যাণ দেখছে, তবে সে তার সাথে প্রতারণা করল”
[মুসনাদে আহমাদ, বাইহাকী শরীফ]
গত তিন পর্বে মোটামুটি আলবানী সাহেবের অভিযোগের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করা হযেছে। একটা বিষয় অবশিষ্ট রয়েছে। ইমাম বোখারী রহ. এধরণের কথা বোখারী শরীফে বলেছেন কি না, এ বিষয়ে একটি ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন আলবানী সাহেব। যারা আলবানী সাহেবের তাহকীকের অবস্থা সম্পর্কে অবগত নন, তারা আলবানীর এই কথায় সন্দেহে প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। অথচ তারা কখনও বিষয়টি যাচাই করে দেখার প্রযোজনীয়তা অনুভব করে না। অন্যদেরকে অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করলেও এদের মধ্যে যে পরিমাণ অন্ধ অনুসরণ ও গোড়ামী দেখা যায়, তা অন্য কারও মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। তাদের ভাবখানা এমন যেন আলবানী সাহেব কোন ভুলই করতে পারেন না। অন্যের নামে অপপ্রচারে লিপ্ত না হয়ে নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নেয়ার চেষ্টা অনেক কল্যাণকর। আশা করি তথাকথিত লা মাযহাবী ও সালাফী ভাইগণ বিষয়টি অনুধাবন করবেন।